আধুনিকতায় বাংলা কবিতা!!! All Bangla Kobita Dot Com
আদি কবি বাল্মীকির
ক্রৌঞ্চমিথুন-বিয়োগ-জনিত শোকই শ্লোকরূপে উৎসারিত হয়েছিল। সহচারী-বিয়োগকাতর
ক্রৌঞ্চের বেদনায় কবি চিত্তে বেদনার সঞ্চার হয়। এই বেদনা থেকেই সহসা ‘অপূর্ব
ছন্দে কবি-কণ্ঠে উচ্চারিত হল-
এই হল কবিতার জন্মরহস্য। সেই তুলনয় বাংলা
কবিতার বয়স চর্যার কাল থেকে ধরলে হাজার বছর মোটে। কবিতা তো সাহিত্যের সেই হিরন্ময়
হাতিয়ার যা মানব অন্তরকে দলিত, মথিত ও স্পন্দিত করে;
সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের পক্ষে যা
সম্ভব নয়। বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাস কবিতার
দ্বারা গদ্যরাজ্য জয়ের ইতিহাস।” আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সম্ভবত এ কথার যথার্থতা
অনস্বীকার্য। সাধারণ
মানুষের জীবনে আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিক
কবিতার বিশেষ কোন ভূমিকা আছে কিনা সে সম্পর্কে অতীতেও বিতর্ক ছিল আজও হয়তো আছে
কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বিপুলভাবে যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে গেলেও কবিতাকে নির্বাসিত
করা
হয়নি।বর্তমান কালের কবিতা মানবীয় ইচ্ছাকে
অতিক্রম করে মানব স্বভাবের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে প্রকৃতির মত।কবিতার উদ্দেশ্য,
পরিধি,
গঠন,
কৌশল,
ছন্দ,
আবৃত্তি
ইত্যাদি কারণে দশকে দশকে বদলে গেছে কবিতা। কবিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা
হয়েছে নিয়মিত। রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায়
ত্রিশের কবিরা কবিতা বদলে দিয়েছেন। এই রেশ কাটতে না কাটতেই হাজির হয়েছেন চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের
কবিরা। প্রতিটি দশকেই কবিতার উন্নতি অনেক স্পষ্ট হয়েছে। দশকওয়ারি এই বিবর্তনধারায়
বাংলা কবিতা
সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে অনেক কবিকেই দশকের ছকে
বেঁধে ফেলা যায় না। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে ভালো কবিতা লেখার একটি চেষ্টা
সবার মধ্যেই ছিল। এই চেষ্টার পেছনে রয়েছে মানুষ যাতে কবিতা থেকে
দূরে চলে না যায়, সাধারণ মানুষের ভাষা
থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। গদ্য ভাব প্রকাশের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। ছন্দোবদ্ধ
কবিতা যথাযথ ভাবপ্রকাশের গতির সাথে চলতে পারত না। তাই অনিবার্য ছিল
অক্ষরবৃত্ত বা গদ্য কবিতার। এতে কবিতার
সুসময় ফিরে এসেছে তা নয়। তবে কবিতা মাঝে মাঝে তীব্র আলোর ঝলকানি ছড়িয়েছে।
‘সকলেই কবি নন। কেউ কেউ কবি;’ কবি ও কবিতার স্বরূপ
কী?
- এটা নিয়ে দ্বন্দ্বের শেষ নেই। আধুনিক
বাংলা কবিতা কেমন হবে?
- সেটাও শেষপর্যন্ত দ্বন্দ্বের বিষয়।
‘আধুনিক কবিতা এক আন্তর্জাতিক’প্রপঞ্চ;যা আধুনিক বা আধুনিকতাবাদ নামে অভিহিত। এর জন্ম
পাশ্চাত্যে এবং কালের প্রভাবে তা ক্রমে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।আধুনিক শব্দটি
এসেছে অধুনা শব্দ
থেকে;যার আভিধানিক অর্থ সম্প্রতি বা আজকাল।সে
সূত্রে আধুনিক শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় সাম্প্রতিক বা আজকালকার।সুতরাং আধুনিক কথাটির
কালগত তাৎপর্য্য রয়েছে।রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,’পাঁজি মিলিয়ে মডার্নের সীমানা নির্ণয় করবে
কে?
এটা কালের কথা ততটা নয় যতটা ভাবের
কথা।’-(‘আধুনিক কাব্য’,সাহিত্যের পথেঃরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। অর্থাৎ সময়কে
তিনি গৌণের কোঠায় ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু জীবেন্দ্র সিংহ রায় রবীন্দ্রনাথের এ
বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন,’আধুনিক শব্দের ব্যুৎপত্তির
দিকে লক্ষ্য রাখলে তাঁর বক্তব্য মেনে
নেওয়া যায় না।কেননা আধুনিকতা কখনও সাম্প্রতিকতাকে বাদ দিয়ে আসতে পারে না। কালের
বর্তমান পদচিহ্ন অনুসরণ করেই তার যাওয়া আসা।’-(‘আধুনিকতা,আধুনিক কবিতার মানচিত্রঃজীবেন্দ্র সিংহ
রায়)।
রবীন্দ্রনাথ,মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র
গুপ্ত তাঁদের সময়ে নিশ্চয়ই অনাধুনিক ছিলেন না।শিল্পকর্ম তা কোন চিত্রকর্ম বা
কবিতাই তা বিশেষকালের ক্ষেত্রে আধুনিক হতে পারে,সর্বকালেই নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন ১৩০০ সালে
কল্পণা করেছিলেন,
রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজও আমদের হৃদয়ে দোলা
দিয়ে যায়, তা কি আধুনিক বলে?
কালিদাস,শেকসপিয়ার,টলষ্টয় এমন কত ঔপন্যাসিক,নাট্যকার-কবি আছেন
যাঁদের সৃষ্টি প্রত্যেক যুগের পাঠককে নিত্য-নূতনভাবে টানে। সে তো তাঁদের সৃষ্টি
শাশ্বতভাবে আধুনিকবলে নয়-কালজয়ী বলে। শাশ্বতভাবে ‘আধুনিক’ ও ‘কালজয়ী’ সমার্থবাচক
নয়। তাই আধুনিকতা প্রসঙ্গে
‘শাশ্বতভাবে আধুনিক’ কথাটির তাৎপর্য্য
নেই।-(‘আধুনিকতা,আধুনিক কবিতার মানচিত্রঃজীবেন্দ্র সিংহ রায়)। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ বলেছেন, বাংলা ভাষা, শব্দ, চিন্তা ও দর্শন এখন অনেক আধুনিক। কিন্তু
সে
অর্থে আমাদের কবিতাকে যথেষ্ঠ আধুনিক বলা
যাবে না।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতাকে আধুনিক,
অতি
আধুনিক, উত্তর আধুনিক ইত্যাদি নানান অভিধায় দাগিয়ে দেবার প্রবণতা চলে আসছে
বরাবরই। এখন আবার একালের কবিকুলের একাংশ বলছেন, শূন্য দশকের কবিতা, যেন একুশ শতকে সমাজ
আমরাই বাংলা কবিতার আসল আগমার্কা
প্রতিনিধি, আমরাই আধুনিক, আধুনিকের চেয়েও আধুনিক, এমন শূন্যগর্ভ দাবি সেকাল একাল সবকালের
কবিকুলই করে থাকেন। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’ বলে ‘কল্লোল’
গোষ্ঠীর কবিরা নিজেদের জানান দিয়েছিলেন যে,
ভাবের
দিক দিয়ে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত তাদের কবিতাই ‘আধুনিক কবিতা’। বললেন বটে, কিন্তু আধুনিক বাংলা
কবিতার যে সংকলনগুলি তাঁরা প্রকাশ করলেন, তার কোনোটি থেকেই রবীন্দ্রনাথকে
বাইরে রাখতে পারলেন না। ১৯৫৪তে প্রকাশিত
বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে রবীন্দ্রনাথের ১৬টি কবিতা
স্থান পেয়েছিল এবং সংকলনটির ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের পর
নতুন তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই”।(বাংলা
কবিতার সেকাল-একাল : ফাল্গুনী
মুখোপাধ্যায়) , কল্লোল যুগ বলতে বাঙলা সাহিত্যের একটি ক্রান্তি লগ্নকে বোঝায় যখন
বাঙলা কবিতা ও কথাসাহিত্যে আধুনিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। কল্লোল নামীয় একটি
সাময়িক পত্রের মাধ্যমে
একদল তরুণ কবি-সাহিত্যিকের হাতে পাশ্চাত্য
আধুনিকতার পত্তন হয়। অচিরেই অন্যান্য সাময়িক ও সাহিত্য পত্রেও এই আধুনিকতার
অগ্নিস্পর্শ লাগে।
ইউরোপীয় সাহিত্য পর্য্যালোচনা করলে দেখবো,
১৮৮০
সালে বোদলেয়ার,ম্যালার্মের আবির্ভাব কালকে আধুনিকতার সুচনাকাল ধরা হয়।এ সময় কতকগুলো
বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মতবাদের কারণে মানুষ ঈশ্বরবিমুখ হয়ে
পড়েন,সমালোচনা
শুরু
করেন চার্চের একচ্ছাত্রাধিপত্যবাদ ও
বুর্জোয়া সমাজের। এ সময় বিদগ্ধজনেরা সমাজের নৈরাশ্যচেতনা ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে
সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।তাঁরা একেবারে গোড়া থেকেই ছিলেন বিদ্রোহী।সমাজ ও দেশের
পূরানো মতবাদ,ঈশ্বরবিশ্বাস ও চার্চের একচ্ছাত্রাধিপত্যবাদের
সমাজ ও দেশের পূরানো মতবাদ,ঈশ্বরবিশ্বাস ও চার্চের একচ্ছাত্রাধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের চিন্তা,চেতনা ও লেখায় ঈর্ষণীয় সাফল্য ফুটে ওঠে,ফুটে ওঠে নান্দনিক শিল্পকলায়।১৯১০ থেকে ১৯২৫ সালকে ধরা হয় আধুনিকতাবাদের শ্রেষ্ঠ সময়।
এই ধারনার বশবর্তী হয়ে অনেকেই এই
ঔপনিবেশিক মত পোষণ করেন যে, পাশ্চাত্য সাহিত্যের কবিতার মতই হবে আধুনিক বাংলা
কবিতা। এই অনুসরণ শেষপর্যন্ত অনুকরণে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ভাষা
একটি
পরিশীলিত ভাষার রূপ পায়, একটি উন্নত রুচি
তৈরি করে দেন তিনি। নজরুলের হাতে পায় বারুদগর্ভ ভাব ও অগ্নিঝরা সুর-ছন্দ-তাল
প্রকাশের শক্তি ও বীররস, তার হাতে বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে
‘অরুগ্ণ-বলিষ্ঠ-হিংস্র-নগ্ন-বর্বরতায়
অনবদ্য’। শামসুর রাহমান বাংলা ভাষার শরীরে
যোগ করেছেন আধুনিক ও শাহরিক চারিত্র্য; শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতায় ব্যবহার করেছেন অনেক
অপরিশীলিত বা অশ্লীল শব্দ, যা রবীন্দ্রনাথ কল্পনা করতেও পারেতন না। আল
মাহমুদ
সংযোজন করেছেন পরিশীলিত লোকায়ত প্রাণরস।
তা ছাড়া মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান বাংলা
ভাষায় জুতসইভাবে যোগ করেছেন আরবি-ফার্সি শব্দসমষ্টি।
শব্দ-মিথ-উপমা-চিত্রকল্প-কল্পচিত্র ব্যবহারে নতুনত্ব আনয়ন, বাক্য
গঠনে অভিনব ভঙ্গি প্রয়োগ, স্পেস তৈরি ইত্যাদি
বিষয় কোন কবিকে স্বাতন্ত্র্য অর্জনে সহায়তা করে। এতে ভাষার প্রকাশক্ষমতা ও
সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যাচ্ছেতাইভাবে শব্দ প্রয়োগ ও বাক্য নির্মাণ ভাষার
কোনো
কাজে আসে না। লাভ হয় না কারুরই। আসলে এটা
ক্ষমতার ব্যাপার, শুধু ইচ্ছার ব্যাপার নয়।
”তিরিশের দশকের বাঙালি কবিরা এলিয়টের
প্রত্যক্ষ প্রভাবে কবিতা রচনা শুরু করেন। এলিয়টের অনুকরণে কলকাতা নগরীকে তাঁরা
ভাবতে শুরু করেন ভিড়াক্রান্ত লন্ডন নগরীর অশুভ পাপময়তা-পচনশীলতার এতদ্দেশীয়
প্রতিরূপ হিসেবে। (এলিয়টের লন্ডন নিজেই
ছিল আধুনিকবাদের আদিগুরু বোদলেয়ারের
প্যারিসের প্রতিরূপ।) তারপর থেকে দীর্ঘ দিন বাঙালি কবির কাছে আকাশ মানেই ছিল
বিধ্বস্ত নীলিমা, বাতাস মানেই অসুস্থ বিকারগ্রস্ত পঙ্গু মানুষের ঘামের গন্ধে বিষাক্ত,
বিষন্ন।
জীবনানন্দের রাত্রি
– এরকম বর্ণনা এলিয়টভাবিত ও
প্রভাবিত।…”(খোন্দকার আশরাফ হোসেন : ইঙ্গ-মার্কিন কবিতায় আধুনিকবাদ)।
বিগত দুই শতাব্দীর ইউরোপীয় ও লাতিন
আমেরিকার শিল্পকলায় এবং পাশাপাশি সাহিত্যেও ফভিজম, এঙ্প্রেশনিজম, ফিউচারিজম, কিউবিজম, ডাডাইজম ও সুররিয়ালিজম যখন একের পর এক
নতুন মাত্রা ও বিশ্বাস নিয়ে উল্টে দিয়েছে
বিশ্বাস ও চেতনার ধারাকে, তখন এসব
শিল্প-আন্দোলনের রূপকার এবং চর্চাকারীকে সমাজের মূল শক্তির ওপর আঘাত হেনেই এগিয়ে
যেতে হয়েছে। সুররিয়ালিস্ট ব্রেতোঁ (১৮৯৬-১৯৬৬) ঘোষণা করেছিলেন : ‘বিস্ময় সর্বক্ষণ
সুন্দর। যা কিছু
বিস্ময়কর, তা-ই সুন্দর। আর শুধুমাত্র বিস্ময়ই
সুন্দর।’ পরাবাস্তববাদের বা সুররিয়ালিজমের প্রধান লক্ষ্যই ছিল ব্যাঘাত সৃষ্টি করা,
প্রচলকে
ভেঙে ফেলা, শৃঙ্খলাকে বিচলিত করা। সাহিত্যের এমনই একটি যুগসন্ধিক্ষণে বাংলা কবিতা
পরাবাস্ততার পথ
ধরে আধুনিকতার যুগে প্রবেশ করে। এবং এটা
সবাই জানেন, বাংলা কবিতায় এর উদ্যোক্তা ছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ মূলতঃ
জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,অমিয় চক্রবর্তী ও বিষ্ণু দে;যারা কল্লোল যুগের
পঞ্চপান্ডব নামে খ্যাত।এঁদের হাতেই
ইউরোপীয় আধুনিকতার আদলে আধুনিক বাংলা কবিতার গোড়াপত্তন হয়।বাংলায় আধুনিকতার
গোড়াপত্তন হয় ১৯২৫ সালে;যা ইউরোপীয় আধুনিক কবিতার সমবয়সী।এবার একটু ধান
ভানতে শিবের গীত গাওয়া যাক, বেশ কিছুদিন
আগে গুগলে একটা মজার তথ্য পেয়েছিলম।
সোর্সটা এখন ঠিক মনে পড়ছেনা তবে বিষয়টা ভুলিনি। সেটা এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি।
অনেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে বাংলা
সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি বলে মনে করেন। অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথকে, কেউ কেউ আরও পরবর্তী
ত্রিশের কবিদেরই মনে করেন প্রথম আধুনিক কবি। প্রথম আধুনিক বাংলা
কবিতা পাই মাইকেলের কাছ থেকেই। সে জন্য
বলা যায়, তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার জনক।
তিনি ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্য এবং চতুর্দশপদী
কবিতা লিখে বিখ্যাত হন। যদিও বছর সাতেকের সাহিত্যজীবনে লিখেছেন আরও তিনটি
কাব্যগ্রন্থ। তিনিই বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেন মহাকাব্য, সনেট ও মনোনাট্যের।
তিনিই চৌদ্দ মাত্রার পয়ারে
আট-ছয়ের চাল ভেঙে দেন এবং আঠারো মাত্রার
মহাপয়ার রচনা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে বলা হয় যুগসন্ধিকালের কবি।
বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম্ ॥
(ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
তিনি মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সংযোগ
ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি মধ্যযুগের শেষ কবি এবং আধুনিক যুগের প্রথম কবি।
এখন সাধারণ মানুষের পঠিত কবিতা মানেই
আধুনিক কবিতা। বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজও
সমভাবে পঠিত এবং প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকভাবে আধুনিক কবিতা লেখা শুরু করলেও
আধুনিক কবিতা পূর্ণতা
পায় ত্রিশের কবিদের হাতেই। এর আগে
গোবিন্দচন্দ্র দাস থেকে নজরুল ইসলাম পযর্ন্ত ছন্দের দিকে দৃষ্টি রেখেই কবিতা রচনা
করেছেন। একই সালে (১৮৯৯) জন্মগ্রহণ করলেও নজরুলের চেয়ে ভিন্ন ধারায় কবিতা লিখেন
জীবনানন্দ দাশ।তার ‘সাতটি তারার তিমির’
কাব্যগ্রন্থের ‘আকাশলীনা’ কবিতাটিও অসাধারণ মুক্তক অক্ষর বৃত্তের কবিতা- সুরঞ্জনা,
ওইখানে
যেয়ো নাকো তুমি;/ বলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে/ ফিরে এসো সুরঞ্জনা/ নক্ষত্রের রূপালী
আগুন ভরা
রাতে। তিনিই প্রথম সফল ও সার্থক গদ্য
কবিতা রচনা করেন। ‘বনলতা সেন’ যেমন জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ, তেমনি নজরুলের
শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণা’।
‘অগ্নি-বীণা’র ১৮ বছর পর প্রকাশ পায় ‘বনলতা
সেন’। বাংলা জনপ্রিয়তম কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে এ দুটি অন্যতম। নজরুল ‘বিদ্রোহী’
কবিতা লিখেছেন ৬ মাত্রার মুক্তক মাত্রাবৃত্তে।ত্রিশের প্রধান পাঁচ কবির অন্যরা
হলেন অমিয় চক্রবর্তী,
আধুনিক কবিতার স্রষ্টাদের মধ্যে জীবনান্দ
দাশ প্রধান পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর কবিতায় একদিকে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময়
প্রকৃতি ও পুরাণ হয়ে উঠেছে রূপময়; অন্যদিকে আধুনিক নগর জীবনের হাতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা,
বিষাদ ও
সংশয়ের চিত্র দীপ্যমান। বুদ্ধদেব বসুর
ভাষায়, “জীবনানন্দ প্রকৃত কবি ও প্রকৃতির কবি। … জীবন ক্ষয়শীল ও পরিবর্তনশীল,
মৃত্যুতে
সবকিছুরই সমাপ্তি, এই আদিম বেদনা জীবনানন্দর কাব্যের ভিত্তি। … আমাদের কবিদের মধ্যে
জীবনানন্দ সবচেয়ে কম ‘আধ্যাত্মিক’,
সবচেয়ে
বেশি ‘শারীরিক’; তাঁর রচনা সবচেয়ে কম বুদ্ধিগত, সবচেয়ে বেশি ইন্দ্রিয়নির্ভর। তাঁর একটি
কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন ‘চিত্ররূপময়’, জীবনানন্দর সমগ্র কাব্য সম্বন্ধেই এই
আখ্যা প্রযোজ্য।” আবার
লোকজ শব্দের প্রয়োগে এবং ধীরলয়ের ছন্দের
বন্ধনে তাঁর কবিতা (‘নির্জন স্বাক্ষর’ ও ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’) ভিন্ন স্বাদযুক্ত ও
মন্থর গতি সম্পন্ন। যেমন:
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে পথের পাতার মত
তিরিশোত্তর বাংলা কাব্যে আর একজন
শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি অমিয় চক্রবর্তী।
বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র-প্রভাবিত কাব্য
জগতের বাইরে তাঁর অবস্থান। তাঁর কবিতার পটভূমিকা চার মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তাঁর
রচনার মধ্যে যে- মানুষটিকে আমরা দেখতে পাই সে অনবরত ঘুরে বেড়ায় এবং
বাসা-বদল করে, অস্থিরতার মধ্যেই অন্তরতম গভীরের দিকে চোখ
খুলে রাখে। [বুদ্ধদেব বসু: কালের পুতুল] আর প্রথম জীবনে ‘সংগতি’ কবিতায় তিনি ঝোড়ো
হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার ‘মিলন-সংগীত’ গেয়েছিলেন, এই সংগতিই তাঁর
সকল কবিতার মূল সুর। ‘আধুনিক ছাঁচে ঢালাই
করা’ মন নিয়ে এই কবি ‘ঈশ্বরিত মানুষের কথা’ বলেছেন। অমিয় চক্রবর্তীকে আধুনিক
পৃথিবীর বাউল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় যার অন্তরে মরমিয়া সুরের একতারা
বেজে ওঠে। আবার বুদ্ধদেব বসুর মতে,
কলাকৌশলের
দিক থেকে তাঁর কাব্য দুঃসাহসিক।
১৯২৩-এ ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশের ফলে যে
নতুন সাহিত্য উদ্যম ও ব্যতিক্রমী শিল্পচেতনার সৃষ্টি হয় সেই নতুন সাহিত্যগোষ্ঠীর
অন্যতম হলেন বিষ্ণু দে।
বিলাও বেগের আভা… (জল দাও – বিষ্ণু দে)
তিরিশোত্তর কাব্যধারায় বিষ্ণু দে-র মধ্যেই
প্রথম রবীন্দ্রকাব্যজগৎ অতিক্রমণের সার্থক প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বিষ্ণু দে-র
ঐতিহ্যচেতনা দেশকাল সীমানাহীন, সমকালীন কাব্য আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির সাথে যুক্ত
এবং ক্লাসিক-রোম্যান্টিক অভিজাত-দেশজ ধারা থেকে পরিগ্রহণে
বিশ্বাসী। ইতিহাস সচেতন এই কবি সমকালীন
সমাজের সংকট সাম্যবাদী বিপ্লবের পথে সমাধানে বিশ্বাসী এবং তত্ত্বগত দিক থেকে
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বা মার্কসবাদে গভীরভাবে আস্থাশীল। তাঁর এ-চেতনা ‘বাইশে জুন’
ও ‘সাত ভাই
চিনি সে তীব্র সুখ, সাত ভাই জাগে,
নন্দিত
দেশ-দেশ।
তিনি বাংলার রূপকতা, ছড়া, লোকসঙ্গীত অর্থাৎ
লোকঐতিহ্যের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির ভাষাকে কাব্যরূপ দেন। আবার তিনি
বাংলা কাব্যের অন্যতম প্রধান প্রেমের কবি। রবীন্দ্র-উত্তর আধুনিক কাব্যধারার
প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে
তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকা আধুনিক
কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
প্রাথমিকভাবে তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথ-মোহিতলাল-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-নজরুলের প্রভাব
যেমন পড়েছে, তেমনি পরবর্তী সময়ে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-অমিয়-র কাব্যছায়া ফেলেছে
এবং আরো পরে বোদলেয়ার-লিরকের প্রভাব
সঞ্চার করেছে। কবিজীবনের প্রথম দিকে তিনি ‘বন্দীর বন্দনা’র মাধ্যমে দেহ ও আত্মার
দ্বন্দ্ব, আদর্শ ও বাস্তবের দ্বন্দ্ব, প্রবৃত্তি ও প্রেমের দ্বন্দ্বকে প্রকাশ
করেন। এ সম্পর্কে
তিনি নিজেই বলেন: এক অতি তরুণ বাঙালি কবি,
আজ থেকে
তিরিশ বছর আগে, পাঠক সমাজে বিক্ষোভ তুলে ঘোষণা করেছিলেন যে, ভগবান ও মানুষ পরস্পরের শত্র“ ও
প্রতিদ্বন্দ্বী, কেননা যে-আদিমানব বিধাতার
সৃষ্টি যে অসহায়ভাবে পাশব বৃত্তির অধীন,
কিন্তু
সেই মানুষই তার আপন সাধনার দ্বারা নিজেকে সংস্কৃত ও রূপান্তরিত করেছে, হয়ে উঠেছে কবি ও শিল্পী,
ঈশ্বরের
মতোই স্রষ্টা। নবযৌবনের স্পর্ধা বলতে যা-কিছু
বোঝায়, এই কবিতাটি তার দৃষ্টান্তরূপে গণ্য হতে
পারে, এবং এর
প্রথম প্রকাশের কাল আমাদের সাহিত্যপঞ্জিকায় বিদ্রোহের ঋতু বলে চিহ্নিত। [সঙ্গ:
নিঃসঙ্গতা: রবীন্দ্রনাথ]
‘বিংশ শতাব্দীর সমানবয়সী’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ১৯৪৫’ কবিতায় দেখি –
মননের চর্চা ও নাগরিক বিদগ্ধতা তাঁর
কবিতায় সর্বত্র প্রতিফলিত। স্তেফেন মার্লামে, তাঁর দুই স্বনামধন্য শিষ্য পোল ভেলেরি ও
কবি-উপন্যাসিক মার্সেল এই তিন জনকে সংমিশ্রণ করে তিনি গ্রহণ করেন তাদের কাব্যাদর্শ।
রবীন্দ্রযুগে জন্মগ্রহণ করেও তিনি
রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত কবি। তবে রবীন্দ্ররীতি বর্জন করার কোনো চেষ্টা তিনি করেননি,
বরং
যথেচ্ছ আহরণ করেছেন রবি-শস্যের সম্পদ থেকে; রবীন্দ্রনাথের শব্দ-সমাবেশ, এমনকি বাক্যাংশ
অনায়াসে চালিয়ে দিয়েছেন নিজের
রচনার মধ্যে, রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর অন্তরেই বিরাজমান
একথা সুধীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে বেশ সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশ করেছেন; অথচ সর্বত্র,
সমানভাবে
এবং সমগ্রভাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যই তাঁর ধরা পড়েছে। [ জীবনানন্দ:
কবিতার কথা]
তাঁর মতে, ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী।’ এই
নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব তিনি অনুভব করেন অসহ সভ্যতার মাঝখানে, চৈতন্যের
নির্জনদ্বীপে এবং তা দেশকালের পটভূমিতে। আবার বোদলেয়ারের মতো অস্বাস্থ্যকর ‘নিজস্ব
নরকে’ বসবাস
করে তিনি ব্যর্থতার পীড়ায়, মর্মদাহে ও আর্তনাদে জর্জরিত। সে জন্যে তাঁর কবিতার নায়কের মধ্যে কোনো ধরনের সান্ত¡না, আশা, আশ্বাস বা মুক্তির চেতনা নেই। নায়িকার শরীর ব্যতীত কিছুই দেওয়ার নেই। সুধীন্দ্রনাথের
করে তিনি ব্যর্থতার পীড়ায়, মর্মদাহে ও আর্তনাদে জর্জরিত। সে জন্যে তাঁর কবিতার নায়কের মধ্যে কোনো ধরনের সান্ত¡না, আশা, আশ্বাস বা মুক্তির চেতনা নেই। নায়িকার শরীর ব্যতীত কিছুই দেওয়ার নেই। সুধীন্দ্রনাথের
প্রধান পরিচয় তিনি বঙ্গদেশে আধুনিক কবিতার
প্রধান প্রবক্তা। তাঁর ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধকে আধুনিক বাংলা কবিতার ইশতেহার
হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
ত্রিশের দশকের আরও গুরুত্বপূর্ণ কবি
রয়েছেন: প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি। (যে টেলিফোন
আসার কথা -পুর্ণেন্দু পত্রী)
অবশ্য এই দুইজনের সাথে বুদ্ধদেব বসুকে
মিলিয়ে কল্লোলযুগের প্রধান তিন কবিও বলা হয়। ত্রিশের কবিরাই মূলত আধুনিক কবিতার
পুরোধা। সমসাময়িক কবি জসীমউদ্দীন পল্লিকবি খ্যাতি লাভ করেছেন, কিন্তু যুগের সাথে
তিনি
হাঁটেননি। মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে
তিনি মধ্যযুগের মতো কাহিনিকাব্য রচনা করেও আলোচিত হয়েছেন।
আমার বাড়ি সবার বাড়ি/রইবে না ক দুর। (সবার
সুখে –জসীমউদদীন)
তিরিশোত্তর বাংলা কবিতায় অন্যান্য কবিদের
মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, সঞ্চয় ভট্টাচার্য, অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত অন্যতম। প্রেমেন্দ্র মিত্র উত্তর-তিরিশের আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের
স্থপতিদের মধ্যে একজন ও কল্লোলগোষ্ঠীর শক্তিমান ও সৃজনশীল লেখক
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০১-৭৬) ও
মুরলীধর বসুর সহযোগিতায় তিনি ‘কালি-কলম’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরাবাস্তবতাভিত্তিক
গণমানুষের প্রতি সংবেদনশীল যে সাহিত্যধারা কল্লোলগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তার
প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায় ও কথাসাহিত্যে। প্রকৃতপক্ষে,
সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরাগই তাঁর
সাহিত্যকর্মের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। অজিত দত্ত-ও ‘কল্লোলে’র নিয়মিত লেখক। বুদ্ধদেব
বসুর সঙ্গে মিলে ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন ‘প্রগতি’ পত্রিকা এবং ‘কবিতা’ পত্রিকার
প্রথম দিকের যুগ্ম
সম্পাদকের একজন, পরবর্তীতে ‘দিগন্ত’ নামে একটি সাহিত্য
পত্রিকা দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেন।
এছাড়াও অজিত দত্ত প্রকৃতি প্রেম ও
রোমান্টিক প্রেমের কবিতা সৃজনে বেশি পারদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন।অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে অতি আধুনিক ধারা
সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯২৫-এ তিনি ‘কল্লোল’ পত্রিকা পত্রিকা
প্রকাশের সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একদিকে রোমান্টিকতা, অন্যদিকে গণচেতনা
তাঁর কবিতার ভাববস্তু নির্মাণে বৈচিত্র্য এনেছে।এইসব কবির সমবায়ে বাংলা কবিতায়
প্রকৃত আধুনিকতার সৃষ্টি হয়।
বিশ শতকের চল্লিশের দশক
আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে ক্রান্তিকালীন সময়রূপে চিহ্নিত। এই সময়ে বাংলা,
ভারতবর্ষ
এবং সমগ্র বিশ্ব ভয়াবহ সংকট, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে উত্তাল। এই দশকের কবি
অরুণকুমার সরকারের ভাষায়: “আমরা চল্লিশের
কবিরা, ইতিহাসের এক ঘোরতর সংকটকালে আমাদের যৌবনের
দিনগুলি অতিবাহিত করেছি। পৃথিবীজোড়া যুদ্ধ, শহর-ভর্তি বুভুক্ষ-মানুষের মৃতদেহ,
ঘৃণ্যতম
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আত্মঘাতী রক্তপাত, ছিন্নমূল উদ্ভ্রান্ত মানুষ, উচ্ছৃঙ্খল সমাজবন্ধন
এক কথায়, মানবিক মূল্যবোধ এবং
মানব-সম্পর্কের এক শোচনীয় অমাবস্যায় বোবা
দুঃস্বপ্নের জগৎ ছিলো আমাদের।” এই সময়ে রচিত কবিতা সে কারণে নানা দিক থেকে
বিশেষত্বপূর্ণ। চল্লিশের দশকে এলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র,
সমর সেন,
সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ – যাঁদের কবিতার শব্দে গভীরতর জীবনবোধ ও সামাজিক চৈতন্যের
অঙ্গীকার। সমর সেন লিখলেন, “তবু জানি কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী /
যুগে যুগে নতুন
জন্ম আনে, / তবু জানি জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে,
চূর্ণ
হবে, ভষ্ম
হবে / আকাশ গঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে… / ততদিন নারী ধর্ষণের ইতিহাস / পেস্তাচেরা
চোখ মেলে শেষহীন
পড়া / অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো,
/ ততদিন
গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে / বণিকের মানদন্ডের পিঙ্গল প্রহার”।
এর পরও অনেকে বলেন, কবিতায় আধুনিকতা
এসেছে চল্লিশের দশকে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, চল্লিশের দশকের অধিকাংশ কবিই সাম্যবাদী বা
সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ছিলেন। অবশ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমি এ
জন্যে
দায়ী। কয়েকজন ব্যক্তিবাদী কবি [কবিতা সিংহ
, নীরেন্দ্রনাথ
চক্রবর্তী, অরুণকুমার সরকার, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, নরেশ গুহ, বিশ্ব বন্দোপাধ্যায়,
কামাক্ষী
প্রসাদ অন্যতম] ছাড়া এ দশকের প্রায় সকলেই মার্কসীয় পন্থায় সমকালীন সংকটপূর্ণ সমাজ
ব্যবস্থা থেকে মুক্তিপিয়াসী এবং একটি
স্বাপ্নিক সমাজ-কাঠামো গড়ায় আশাবাদী।
তাঁর কবিতায় নগর জীবনের গ্লানি ও ক্লেদ,
মধ্যবিত্ত
জীবনের সঙ্কট, সংশয়, নীতিহীনতা, আত্মকেন্দ্রিকতা প্রতিফলিত। এই দশকের অন্য
খ্যাতিমান কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। কবিতার বিষয়বস্তু ও শিল্প-প্রকরণের ক্ষেত্রে
তিনি অসামান্য পারদর্শিতার পরিচয়
দিয়েছেন। সাম্যবাদী ও গণমানুষের
মুক্তিকামী এই কবিকে ‘শক্তিমান’ এবং তাঁর কবিতা ‘অভিনব’ উল্লেখ করে বুদ্ধদেব বসু
বলেন: “সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য: প্রথমত, তিনি বোধ হয় প্রথম
বাঙালি কবি যিনি
প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন
না। এমন কি, প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; কোনো অস্পষ্ট, মধুর সৌরভ তাঁর রচনায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম
কবিতাগুলিতে লক্ষণীয় ছিলো। দ্বিতীয়ত,
কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে
কাব্যরচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় [‘পদাতিক’]
শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।”[বুদ্ধদেব বসু: কালের পুতুল]
করছে টাকা কাঁড়ি কাঁড়ি (বলছিলাম কী –
সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
বাংলা কবিতায় ষাটের দশকে একঝাঁক তরুণ কবি
প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে আক্রমণ নিজেদের ‘হাংরি জেনারেশন’ বলে ঘোষণা করেন, এবং জীবনানন্দকে
তাদের নিজস্ব ভাবধারার পূর্বসূরী বলে দাবি করেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা
শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে
হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়
এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় ।১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয়
মজুমদার,
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু,
সুবিমল
বসাক, ত্রিদিব
মিত্র, ফালগুনী
রায়, আলো
মিত্র, অনিল
করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী,
সুবো
আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক,
শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়,
অমৃততনয়
গুপ্ত, ভানু
চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র,
দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । অনিল এবং
করুনা ছিলেন চিত্রকর । সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে তোলার
চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু, অরুণ বণিক,
অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার,
কিশোর
সাহা, জামালউদ্দিন,
জীবতোষ
দাশ, দেবপ্রসাদ
মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়,
বিজন
রায়, রবিউল,
সমীরণ
ঘোষ, রতন
নন্দী, রাজা
সরকার,
সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত,
সুব্রত
রায়, সুব্রত
চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু ,
স্বপন
মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ।হাংরি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
রিডার ড, শঙ্কর ভট্টাচার্য
লিখেছেন যে সেগুলো “সাধারণত প্রতিবাদ-মুখর,
আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত,
প্রাতিস্বিকতায়
ভঙ্গুর, অস্হির, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক” । কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান ড.
তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল
ভাংচুর” করেছেন তাঁরা, এবং “যৌনতার সঙ্গে এসেছে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায়
মানুষের নিস্ফলতার যন্ত্রণা; আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়ে তঁরা নিরপেক্ষ হয়ে যান” ।
মাত্র চার বছর স্থায়ী হয়েছিল এই আন্দোলন
। সুনীল , শক্তি, বিনয় মজুমদার, উৎপল বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা হাংরি দর্শনেই
প্রভাবিত হয়ে তাদের কাব্যজীবন শুরু করেছিলেন । সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’ অবশ্য ঘোষণা
করেছিল হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাদের
সম্পর্ক নেই । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেও তাঁর অবস্থান পরিস্কার করে জানিয়েছিলেন
“আমি হাংরি জেনারেশান পছন্দ করি না (সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে),আমি ওদের কিছু-কিছু
পাজী ব্যবহারে বিরক্ত
হয়েছি”। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৬৪ তেই
হাংরি সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন । বিনয় মজুমদার, উৎপল বসুরাও মূল স্রোতে ফিরে বাংলা কাব্য
জগতকে দারুণ সমৃদ্ধ করলেন । “ধরো, আমি একটি কবিতা পড়লাম। তারপর
সেই কবিতা থেকে মনে মেন আবৃত্তি করলাম-
‘আমি ফাগুন এলে কুড়িয়ে নেব’। সঙ্গে সঙ্গে কবির মুখটা আমি দেখতে পাচ্ছি-হাবড়া
প্ল্যাটফর্মে”। – বিনয় মজুমদারের এই উপলব্ধিই যেন কবি, এবং কবিতা। কবির
জীবনযাপনের সঙ্গেই, তাঁর কবিতার উপলব্ধি
বসবাস করে। পাঠকও এই উপলব্ধির মধ্যে প্রবেশ করে। তখন কবি এবং কবির দর্শনকে পাঠক
দেখতে পায়। কবির প্রতিটি কবিতা একটি অভিজ্ঞতামুহূর্ত। তাঁর কাব্যের প্রকাশ হয়ে
স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ – ষাট – সত্তর
দশকের সময় কালটা বাংলার সমাজ জীবনের এক ক্রান্তিকাল বলেই চিহ্নিত । একদিকে তীব্র
প্রতিষ্ঠান বিরোধী গণ আন্দোলন যাকে আরো তীব্রতর হওয়ার রসদ যোগাচ্ছিল
সেই সময়ের সাহিত্য, নাটক । এবং ৬৯’এ
তরাই’এর নকশাল বাড়ির কৃষক বিদ্রোহ । যে সময়কালে কবিতা- গল্প- উপন্যাসে মানুষ কান
পেতে আরো বেশি ‘সময়ের প্রতিধ্বনি’ শুনতে চাইছিল , এই সব
অনিবার্য চাহিদাগুলো যারপরনাই খামচে ধরে
সত্তর আশির দশকে কবিতা লিখতে আসা একঝাঁক মেধাবী তরুণকে। তাঁরা প্রথমেই এমন সব
প্রশ্নের মুখোমুখি হন যে, তাঁরা কেন, জাতি হিসাবে কী হবে তাঁদের প্রকৃত
পরিচয়, স্বজাতির মধ্যেই কেন বিভেদ বৈষম্যের
চোরাজাল, তাঁদের আত্মপরিচয়ের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণে কেনইবা এত আলোছায়া, মেঘরৌদ্রের লুকোচুরি
খেলা!
এবং এসব জিজ্ঞাসা থেকেই ষাটের কবিরা
আত্মআবিষ্কার ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে নিজেদের সঠিক পরিচয় রচনা করতে শেখেন। শেখেন
কবিতায়, রাজপথে, বিবৃতিতে, ঘরে-বাইরে, অন্তরে। এ সময়ে কবিতা লিখে ব্যাপক আলোড়ন
সৃষ্টিকারী
কবিদের মধ্যে অন্যতম মল্লিকা সেনগুপ্ত
সুবোধ সরকার কৃষ্ণা বসু জয় গোস্বামী,আশীষ স্যন্যাল, শুভ দাশগুপ্ত, পরবর্তী দশকের (সত্তর, আশি কিংবা নব্বইয়ের)
কবিদের মধ্যেও দুই বাংলাতেই তসলিমা নাসরিনের দাপট খুব কম নয়।
জয় গোস্বামীর চাইতে তার পাঠকপ্রিয়তা বেশি
না হলেও কম নয়।এরপরেও রয়েছেন মন্দক্রান্তা সেন, পল্লব কীর্তনীয়া, প্রমুখেরা।
আলাদা করে কারো নাম উল্লেখ না করেও বলাই
যায় নয়ের দশক পেরিয়ে শূণ্য দশকে এসে অনেক বেশি সাবালক হয়েছে বাংলা কবিতা। নব্বই ও
শূন্য এই দুই দশক মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা
গান…সুমন থেকে বাংলা ব্যান্ড…যেভাবে
নিজেকে ভেঙ্গেছে…তা বাংলা কবিতাকে অনিবাযত পরিশীলিত করেছে।মহীনের ঘোড়াগুলির মণিদা
বা সুমনচট্টোপাধ্যায়(অধুনা কবীর)-এর কাছে আমাদের,বাংলা কবিতালিখিয়েদের ঋণ অনেক।আর এ সময়ে
আবার বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন কলকাতা ছাড়াও
বাংলা ভাষাভাষী নানান অঞ্চল থেকে বেরোতে
থাকে,এই দুই
দশকের সাহিত্যে যেগুলি খুবই গুরুত্বপূণ্র। প্রিন্টমিডিয়া, ব্লগ, লিটল ম্যাগাজিন(
লিটল হলেও সেই সন্দীপ দত্তর ভাষায় লোডেড ম্যাগাজিন.)আধুনিক কবিতার জোয়ারে প্রাণ
ঢেলে দেয়।
একঝলক নজর ফেরাই বাংলাদশের
দিকে।সুচারুভাবে বাংলাসাহি্ত্যের চর্চা চলছে সেখানেও। নজরুলের পর এই চল্লিশের
দশকেই আরো বেশ কয়েকজন আধুনিক কবিকে পাই: ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব ও সৈয়দ আলী আহসান এর মধ্যে
প্রধান। সৈয়দ আলী আহসান ভাঙা গদ্য ও টানা
গদ্য কবিতাও লিখেছেন। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর কবিরাও ভাগ হয়ে গেছেন।হাসান
হাফিজুর রহমান, সুফিয়া কামাল আল মাহমুদ প্রমুখ কবিরা পঞ্চাশ ও ষাটের
দশকের কবি হিসাবে স্বীকৃতি পান। বলা হয়,ত্রিশের কবিদের পর
বাংলা কবিতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় চার কবি হলেন, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আল মাহমুদ এবং শক্তি
চট্টোপাধ্যায়। দুজন এ বাংলার, দুজন ও
বাংলার; শামসুর রাহমান শুরুতে মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে
প্রাধান্য দিয়ে তিন ছন্দেই লিখেছেন; কিন্তু তিনি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন মুক্তক
অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখেই। শামসুর রাহমানের অধিকাংশ কবিতা মুক্তক অক্ষরবৃত্তে
সাজানো। তিনি মুক্তিযুদ্ধের
এবং শহরের আধুনিক কবি হিসাবেই নিজেকে মেলে
ধরেছেন। তিনি মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, স্বরবৃত্ত, গদ্য ছন্দ কিংবা সনেট-সবর্ত্রই সাবলীল;
কিন্তু
মুক্তক অক্ষরবৃত্ত তার স্বাভাবিক ছন্দ। শামসুর রাহমানের পর গুরুত্বপূর্ণ কবি আল
মাহমুদ।
একইভাবে তিনিও শুরু করেছিলেন ছন্দোবদ্ধ
কবিতা লিখে। তার সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি হলো ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’ ও
‘সোনালী কাবিন’। আল মাহমুদ প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখে কবিখ্যাতি পেলেও সবচেয়ে
বেশি
আলোচিত হয়েছেন ‘সোনালী কাবিন’
কাব্যগ্রন্থের সনেটগুলো লিখে। তবু তার শেষ আশ্রয় আধুনিক গদ্য কবিতায়। রফিক আজাদ,
মোহাম্মদ
রফিক, হুমায়ুন
আজাদ একই সময়ের অন্যতম প্রধান কবি। এর মধ্যে হুমায়ুন আজাদ তার
শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’ -এ
ছন্দ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো গদ্য কবিতাতেই কাব্য সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ
পায়। গদ্য কবিতা কবিতার বিবর্তনের আধুনিকতম রূপ। বিশ শতকের শেষ কয়েক দশক ও
একুশ শতকের শূন্য দশকে এসে আমরা বাংলাদেশে
অসংখ্য তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবির দেখা পাই। বদরে মুনীর, আলফ্রেড খোকন, কামরুজ্জামান কামু, রহমান হেনরী,
টোকন
ঠাকুর, সরকার
আমিন, ব্রাত্য
রাইসু, তপন
বাগচী, সুব্রত
অগাস্টিন গোমেজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, আবু হাসান শাহরিয়ার,
জাহিদ
হায়দারসহ আরো অনেকে কবি স্বীকৃতি পেয়েছেন। শুন্য দশকের কবিঃ অনিন্দ্য আকাশ,
অপূর্ব
সোহাগ, আলী
প্রয়াস, ত্রিস্তান আনন্দ, অবনি অনার্য, আদিত্য অন্তর, নির্লিপ্ত
নয়ন, সজল সমুদ্র, হিমেল বরকত, সোমেশ্বর অলিঃমধুক্ষরা…এরা গদ্য কবিতার
উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, এগিয়ে নিচ্ছেন। কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ সহজ হওয়া বা অনেক বেশি কবিতা লেখায়
তাদের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অনেক। কিন্তু একটি বহুল আলোচিত
কবিতা এদের কাছ থেকে আসেনি। আরো আগে রুদ্র
মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ তুমুল আলোচিত হয়েছিল। হেলাল হাফিজ
প্রকৃতপক্ষে একটি কাব্যগ্রন্থই রচনা করেছেন, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। এই কাব্যগ্রন্থের
‘নিষিদ্ধ
সম্পাদকীয়’ এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার
তার শ্রেষ্ঠ সময়সহ বেশ কয়েকটি গদ্য কবিতা জনপ্রিয়তা পায়। কবিতার উদ্দেশ্য, পরিধি, গঠন, কৌশল, ছন্দ, আবৃত্তি ইত্যাদি
কারণে দশকে দশকে বদলে গেছে কবিতা। কবিতার
আধুনিক কবিতা হলো একটি শব্দ শব্দ খেলা।
উপমা, উৎপ্রেক্ষা
এবং ভাবানায় তা হয়ে ওঠে আরো পরিপূর্ণ। যিনি যতো বেশি শব্দ নিয়ে খেলবেন তিনি ততো
বেশি ভালো লিখবেন। প্রতিটি শব্দ যদি
হ’য়ে ওঠে চিত্রকল্প তবেই না কবিতার
স্বার্থকতা। তারপর অন্তমিল, ছন্দের বুনন, শব্দ চয়ন তো আছেই। তবে ছন্দহীন টানা
গদ্যের শেষে অন্তমিল কোনো কবিতার পর্যায়ে পড়ে না। সেটাকে নিতান্ত পদ্যের পর্যায়েও
ফেলা যায় না। পদ্যেও কিন্তু ছন্দ থাকে,
তবে
কবিতার মতো ভাবানার বিশালতা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা বা চিত্রকল্পের বালাই নেই সেখানে। আছে
শুধু গল্প-উপন্যাসের মতো ধারা বর্ণনা।
No comments
লেখাটি আপনার কেমন লেগেছে অনুগ্রহ করে কমেন্ট করে জানাবেন।
আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম। আপনিও আপনার জানা বা দেখা যে কোন ওইতিহাসিক-ভ্রমন স্থান সম্পর্কে অথবা আপনার লেখা কবিতা পাঠান আর আমাদের গান ও কবিতা ঘরের সদস্য হয়ে যান। ধন্যবাদ- all-banglakobita.com (ক্লিক করুন -আপনার লেখা)