মা, তুমি সকলের থেকে আলাদা কেন? (গান ও কবিতা ঘর)
মা, তুমি সকলের থেকে আলাদা কেন? বিরক্তিতে
নাকটা কুঁচকে বলতো বর্ণালী। সকলের মা কি সুন্দর মেয়ের টিফিন গুছিয়ে দেয়, হোমওয়ার্ক
করে দেয়, সিরিয়াল দেখে আর ফ্যামিলির সঙ্গে বেড়াতে যায়। আর মিসেস বনলতা চক্রবর্তী
দিনরাত খাতা,পেন নিয়ে কি যেন লিখেই যায়। যদি বুঝতাম, নামি রাইটার তাও একটা পরিচয়
দেওয়ার মত হত। ওদের স্কুলের রম্যানির মা তো গায়িকা। স্কুলে রম্যানির কত সম্মান।
সেখানেও তো সেই হাউজ ওয়াইফ হয়েই রয়ে গেল বর্ণালীর মা। তাহলে মায়ের সবটুকু অ্যাটেনশন
কেন পাবে না বর্ণালী। মা যেন দিনরাত কি সব ভাবছে। বাবা আর ঠাম্মা বলে, মাথাটা নাকি
প্রথম থেকেই খারাপ। মা নাকি চোখে লাল,নীল স্বপ্ন দেখে, পাখির ডাককে গান শোনে।
সংসারের সব কর্তব্য করে মা, তবুও যেন সবসময় নিজের একটা আলাদা জগৎ খুঁজে চলে। কেমন
যেন এলোমেলো উদাসী। ঠাম্মা বলে, চক্রবর্তী পরিবার বলেই অমন আনমনা বউকে মেনে নিয়েছে।
নাহলে সংসারে অমনোযোগী বউকে কেই বা ভালোবাসে? বাবাকেও বলতে শুনেছি, তাও যদি বুঝতাম
কোনো চাকরি করে ভালো ইনকাম করে তবুও মেনে নেওয়া যেত। কি যে ছাইপাশ লেখে বনলতা সেটা
আজও কারোর বোধগম্য হলো না। মিডিওকার মেয়ে, না আছে বড় ডিগ্রি না বিশাল কিছু
সৌন্দর্য, এমনকি বিশাল অবস্থাপন্ন বাড়ির মেয়েও নয় বনলতা।
তারপরেও যে কিসের এত দেমাক
কে জানে! হ্যাঁ, পাড়াপ্রতিবেশী বনলতার এই নির্লিপ্ততাকে অহংকার বা দেমাক নামেই
অভিহিত করেছিল। অবশ্য এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে মানুষটা সে কিন্তু একেবারেই
নিরুদ্বেগ। নিজের মনে সংসারের কাজ করে, নিজের মনে ডায়রির পাতায় হাবিজাবি লেখে,
আনমনে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। বর্ণালী মাকে একবার জিজ্ঞেসাও করেছিল, আকাশে কি আছে
মা? মা বলেছিল, মুক্তির স্বাদ, একমুঠো স্বাধীনতা। বর্ণালী না বুঝেই নেমে এসেছিল ছাদ
থেকে। অদ্ভুত ওর মা। মায়ের এই অনাসৃষ্টি আচরণের জন্যই বর্ণালীর বেশি ভাব ছিল বাবা
আর ঠাম্মার সঙ্গে। ঠাম্মা বলতো, পাগল বুঝলি, নাহলে নিজের ভালো বোঝে না? বাবা বলে,
কেন যে এমন স্বাভাবিক নয় তাই বা কে জানে? রাগ হতো বর্ণালীর, ভীষণ রাগ। মনে হতো মাকে
ওই ভাবনার পৃথিবী থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসতে। আর পাঁচটা সাধারণ মায়ের মত তরকারিতে
নুন বেশি দিক মা, ওকে বকুক, মারুক, বাবার সঙ্গে ঝগড়া করুক...কিন্তু না, ওর মায়ের
এসব কিছুই ভুল হয় না। সেই ছোট্ট থেকে কখনো বর্ণালীকে বকেনি মা। অন্যায় করলে শান্ত
গলায় বলেছে, অলি, তুই জানিস তুই অন্যায় করেছিস, তারপরেও লুকাচ্ছিস কেন? জোর গলায়
নিজের অন্যায়টা স্বীকার করে নিস। তারপর স্বাধীনতা উপভোগ কর। মনে আর কোনো অন্যায়ের
রেশ থাকবে না, ভয় থাকবে না, স্বাধীন তুই। মায়ের এই শক্ত শক্ত কথাগুলোর মানে বুঝতে
পারতো না বর্ণালী। শুধু ভাবতো মা এমন কেন? কত কত বছর কেটে গেল, বর্ণালী স্কুল থেকে
কলেজে গেল, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি কিন্তু বনলতার আর কোনো পরিবর্তন হলো না। বাবা,
ঠাম্মা, পিসিমনি, বর্ণালী সকলের আক্ষেপ রয়ে গেল, ঘরের বউ ঘরের মত হলো না, মা ঠিক
যেন মায়ের মত নয়। কন্যা বিদায়ের সময়েও মা মেয়ের হাত ধরে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদেনি,
শুধু বলেছিল, নিজের ইচ্ছেয় কিংশুককে বিয়ে করলি, এত পড়ালাম চাকরিও করলি না, যখন
পরাধীন হয়ে যাবি তখন বুঝবি খাঁচার পাখিরা কেন ডানা ঝাপটায়। বর্ণালী ওই অর্ধউন্মাদ
মহিলার দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল, এ কেমন মা? বন্ধুদের বিয়ের দিনে দেখেছিল তাদের মায়েরা
মেয়েদের কনকাঞ্জলীর সময় কাঁদে, দুঃখে মুচড়ে যায় আর ওর মা শুকনো চোখে বেশ কিছু
এলোমেলো কথা বলে গেল। বিরক্তিতে মনটা কুঁচকে গিয়েছিল বর্ণালীর। তবে কি মায়ের
কিংশুককে পছন্দ নয়? পছন্দ না হবার মত ছেলে কিংশুক নয়। পেশায় ডাক্তার, সুদর্শন,
বনেদি ফ্যামিলির ছেলে ও। তাই কিংশুককে বাড়ির সকলের পছন্দ, আত্মীয়রা তো বর্ণালীর
কপাল দেখে রীতিমত হিংসা করেছে। সেখানে নিজের মা বর্ণালীর এই বিয়েতে বাধা হয়ে
দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, না আমি এখন বর্ণালীর বিয়ে দেব না।
ও নিজের পায়ে দাঁড়াক তারপর।
নেহাত বাবা আর ঠাম্মা, পিসিমনিরা বেঁকে বসেছিল তাই মা কিছু করে উঠতে পারেনি।
বর্ণালীর তো দৃঢ় ধারণা মা মেয়ের কপাল দেখে হিংসে করছে। বিরক্তিতে মুখটা ঘুরিয়ে
নিয়েছিল বর্ণালী। মা ওর হাতে নিজের নীল রঙের মোটা ডায়রিটা দিয়ে বলেছিল, এটা তোর
গিফ্ট। অবহেলায় শ্বশুরবাড়ির এক কোণে ফেলে রেখেছিল ডায়রিটা। ভুলেই গিয়েছিল বিবাহিত
জীবনের জাঁকজমকে। কিংশুক আর ওর সিঙ্গাপুরে হানিমুন, কিংশুকদের বাড়ির বনেদি
দুর্গাপূজা এসবের ভিড়ে ওই অন্যমনস্ক মা নামক মহিলার অস্তিত্বটাই তো ভুলতে বসেছিল।
বেশ কাটছিল বর্ণালীর দিনগুলো। বাবা প্রায়ই আসতো বর্ণালীর শ্বশুরবাড়িতে। মেয়েকে না
দেখে বেশি দিন থাকতেই পারতো না বাবা। বর্ণালীরও মনখারাপ করলেই বাপের বাড়ি যেত
কিন্তু মায়ের সঙ্গে তেমন কথা হতো না। মা ওদের জন্য ভালোমন্দ পদ রান্না করতো মন
দিয়ে। বর্ণালীর খুব ইচ্ছে করতো মাকে জড়িয়ে ধরে নিজের সংসারের খুঁটিনাটি গল্প করতে।
ও কি কি রান্না শিখেছে সেসব বলতে, কিন্তু মায়ের ওই উদাসীন চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে মনে
হতো, বলেই বা কি হবে, মা কি আদৌ শুনবে? বনলতা চক্রবর্তী তো সেই মহিলা যে নিজের
মধ্যেই নিজে বাঁচে। পারিপার্শ্বিক সব কিছুর মধ্যে বিরাজ করেও নিজেকে আলাদা করে
রাখতে পারে সে। বিয়ের বছর দুয়েক কেটে গেছে, তবুও মাকে বর্ণালীর নতুন সংসারের কথা
কিছুই বলা হয়নি, বলা হয়নি বর্ণালীর মেয়ে থেকে বউ হওয়ার পরিবর্তনের কথা।
বনলতা এখনও
একইভাবে বিকেল হলেই সব কাজ ছেড়ে ছাদে চলে যায়, আকাশে উড়ে যাওয়া পাখিদের দিকে তাকিয়ে
কি সব যেন বলে। না, মাকে আর মায়ের মত করে পাওয়া হলো না বর্ণালীর। বিবাহিত জীবনটাও
বড্ড একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে বর্ণালীর। কিংশুক সারাটা দিন ব্যস্ত থাকে এখন।
হসপিটাল আর প্রাইভেট প্র্যাকটিস মিলিয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ত, সময়ই নেই বর্ণালীকে দেবার
মত। শ্বশুর মশাই আর শাশুড়ির বেড়ানোর বড্ড নেশা। বছরের অধিকাংশ সময় তারা ঘুরে বেড়ায়।
এত বড় বাড়িতে বর্ণালী একেবারে একা। কিছু একটা করতে হবে, কতক্ষণ আর মুভি দেখে বই পড়ে
সময় কাটে মানুষের! কিংশুককে বলতে গিয়েছিল বর্ণালী, কিংশুক অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছে,
কিসের অভাব তোমার, যে হঠাৎ কিংশুক ব্যানার্জির স্ত্রীর চাকরি করার দরকার? দেখো
বর্ণালী, তুমি বিয়ের আগে থেকেই জানতে, আমাদের বনেদি ফ্যামিলি, এ বাড়ির মেয়েরা জব
করতে বেরোয় না। তুমি বাড়িতে যা খুশি করো, কিন্তু প্লিজ...এ ভাবে ব্যানার্জি বাড়ির
সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলো না। কয়েকটা টাকার জন্য তুমি ছোটখাটো অফিসে ঘুরবে, এটা হয়
না। কিংশুকের উত্তর পেয়ে গেছে বর্ণালী। বাড়িতে চারটে কাজের লোক, তাই কাজকর্মও তেমন
নেই। অবসর কাটাতে কাটাতে ক্লান্ত হয়ে যায় ও। শপিং করে, পার্লারে গিয়ে, বন্ধুদের
ডেকে আড্ডা দিয়েও যেন মনের মধ্যে একটা অস্থির হাহাকার কাজ করছে বর্ণালীর। দিনরাত
মনে হচ্ছে বড্ড একা ও। সেদিন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল, কাঁচের জানালাতে এসে বৃষ্টির
ফোঁটাগুলো সজোরে আঘাত করছিল, বর্ণালী নিজের বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির তান্ডব দেখছিল একা
একা। আচমকা মায়ের সেই মোটা ডায়রিটার কথা মনে পড়লো বর্ণালীর। বছর দুয়েক আগে মা
দিয়েছিল ওকে ওর বিয়ের গিফ্ট হিসাবে। আলমারির এককোনে অবহেলায় পড়েছিল এতদিন। খুলেও
দেখা হয়নি। বর্ণালী বৃষ্টিভেজা দুপুরে মায়ের ডায়রিটা খুলে বসলো। মা শুরু করেছে এই
ভাবে। আমার নাম বনলতা মুখার্জী, না, এখন চক্রবর্তী। কিভাবে যেন এতদিনের পরিচিত
সারনেমটা বদলে গেল। একটা অপরিচিত পরিবেশে এসে বুঝলাম, বনলতার আলাদা কোনো অস্তিত্ব
নেই, সে শুধুই চক্রবর্তী বাড়ির বউ। এদের মনোরঞ্জন করাই তার একমাত্র কাজ। সুন্দরী
নই, ব্রিলিয়ান্ট নই, বাবার অবস্থাও তেমন ভালো নয়, তাই বনলতার আলাদা ভাবনা থাকতে
পারে না। তাকে মিশে যেতে হবে চক্রবর্তী বাড়ির নিয়মের সঙ্গে। কবে যেন আমি মানুষটাই
হারিয়ে গেলাম। খুব ইচ্ছে করতো স্বাধীন ভাবে বাঁচি। পাখিগুলোও যেন আমার থেকে ধনী,
অন্তত ডানা মেলে উড়তে পারে, আর আমি ঝাপটাতেই ভুলে গেছি। শুধুই বৌমা, শুধুই স্ত্রী,
শুধুই মা নিয়ে বেঁচে আছে বনলতা। কিন্তু আমার গল্পের নায়িকা বর্ণালী জিতবে।
সে
স্বাবলম্বী হবে। সে হবে নামি লেখিকা। মা একটা বিশাল উপন্যাস লিখেছে, 'রংমশাল' নামে।
যার নায়িকার নাম বর্ণালী চক্রবর্তী। মেয়েটি লেখিকা, তার অবসর কাটে লেখালিখি করে।
উপন্যাসের শেষে বর্ণালী একাডেমি পুরস্কার নিতে যাচ্ছে। ডায়রিটা বুকে জড়িয়ে ধরে
অনেকক্ষন কাঁদলো বর্ণালী। আর দেরি না করেই ম্যানুষ্ক্রিপ্টটা নিয়ে ছুটলো কয়েকজন
প্রকাশকের কাছে। বেশ কিছু প্রকাশক ম্যানুষ্ক্রিপ্টটা রেখে যেতে বললেন কিছুটা
অনাগ্রহ ভরেই। অপরিচিত রাইটারের লেখা ছাপাতে তারা খুব বেশি আগ্রহী নন।
চমৎকার
ReplyDelete